শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:২৫ অপরাহ্ন

নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায় দেশবাসী, এরই মাঝে চলছে চাঁদাবাজি

নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায় দেশবাসী, এরই মাঝে চলছে চাঁদাবাজি

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, বাঘের ভয়ে উঠলাম গাছে সাপ কইলো পাইছি কাছে, আবার এ প্রবাদের ভিন্ন আরেকটি রুপ আছে এভাবে, ‘জলে বাঘ ডাঙ্গায় কুমির’। তারমানে যেখানে যায় সেখানেই বিপদ পিছু ছাড়ে না। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর সরকারের পরিবর্তনের ফলে আমরা সাধারণ জনগণ যখন নতুন স্বচ্ছ সুন্দর একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন বুনছি তখনই শোনা গেলো চাঁদাবাজি-নৈরাজ্যকারীদের একটি পক্ষ পালালেও তারই যায়গায় আরেকটি পক্ষ সর্বত্র চাঁদাবাজি, দখল নৈরাজ্যে লিপ্ত হয়েছে। তবে আজ শুধু চাদাবাজির একটি বড় খাত পরিবহন খাত নিয়ে বিস্তর আলোচনা করবো।

বাংলাদেশের পরিবহন খাতে রাজনৈতিক দলের হাতবদল যে কোনো নতুন সরকারের আগমনের পর একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি নেতাদের হাতে পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত ঢাকা সড়ক পরিবহন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয়টি, যা এতদিন আওয়ামী লীগের আওতাধীন ছিল, এখন বিএনপি সমর্থিত পরিবহন নেতাদের দখলে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের পরিবহন খাত থেকে প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়, যা মূলত বাস-ট্রাক মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে আদায় করা হয়। একটি বাস-ট্রাক থেকে প্রতিদিন ৭০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেওয়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন অজুহাতে মাসিক ও এককালীন চাঁদা তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারের পতনের সাথে সাথে এই চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণও হাতবদল হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলের নেতারা আত্মগোপনে চলে যান, ফলে পরিবহন সমিতিগুলোর অফিস বিএনপি নেতাদের দখলে চলে যায়। বিএনপির নেতা সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া, যিনি পূর্বে বিএনপি সরকারের অধীনে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, এখন আবার সমিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে ৩১ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে। সারা দেশে পরিবহন খাতের এমন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেখানে আগে আওয়ামী লীগপন্থী পরিবহন কোম্পানিগুলো পরিচালিত হতো, সেগুলো এখন বিএনপিপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে।

পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি তিনটি প্রধান উপায়ে সংগঠিত হয়: দৈনিক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদা, নির্দিষ্ট পথে বাস-মিনিবাস চালানোর জন্য মালিক সমিতির চাঁদা এবং রাজধানী ও আশপাশে কোম্পানির অধীন বাস চালাতে ওয়েবিল বা গেটপাসের নামে চাঁদা। টিআইবির একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়, যার একটি বড় অংশ রাজনৈতিক দলের নেতাদের পকেটে চলে যায়।

এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের পরিবহন খাতে রাজনীতিবিদদের প্রভাব অনেক গভীর। বড় বাস কোম্পানিগুলোর ৯২ শতাংশ পরিচালনার সাথে রাজনীতিবিদেরা যুক্ত, যার মধ্যে ৮০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে ক্ষমতা বদলের সাথে সাথেই এই খাতে রাজনৈতিক দলের হাতবদল ঘটে। রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, বাড়তি ভাড়ার চাপ সাধারণ জনগণের ওপর পড়ে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সাধারণ জনগণের ওপর তার প্রতিকূল প্রভাব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা যা অতীতের সরকারগুলোর অধীনে সুরাহা হয়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর সরকারের পরিবর্তন হলেও এই সমস্যার সমাধান হয়নি, বরং নতুন রাজনৈতিক দলের প্রভাবের কারণে চাঁদাবাজির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে।

পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের চেয়ে আরও বেশি। এ খাতে চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত একটি শক্তিশালী পরিবহন নীতি প্রণয়ন করতে হবে। তা না হলে, সাধারণ জনগণের ভোগান্তি ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে।

পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি কমানোর জন্য একটি সমন্বিত ও কার্যকর কৌশল প্রয়োজন। কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে এ সমস্যা কমানো সম্ভব হতে পারে:

১. শক্তিশালী নীতি ও আইন প্রয়োগ
পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদা তোলার ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে যা চাঁদাবাজি বন্ধে আরও কার্যকর হবে।
২. ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম চালু করা
বাস, ট্রাক, বা অন্যান্য পরিবহনের দৈনিক, মাসিক বা অন্য কোনো চাঁদা আদায়ে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম চালু করা যেতে পারে। এতে নগদ চাঁদা তোলার সুযোগ কমবে এবং আদায়ের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে। সব ধরনের পেমেন্ট ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে হলে অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।
৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড স্বচ্ছ করতে হবে। সংগঠনগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করতে বাধ্য করতে হবে। নিয়মিত অডিট ও সরকারি তত্ত্বাবধানে এসব সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হলে চাঁদাবাজির সুযোগ কমবে।
৪. স্বাধীন তদারকি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন
একটি স্বাধীন তদারকি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করা যেতে পারে যা সরাসরি সরকারের অধীনে কাজ করবে। এই সংস্থা পরিবহন খাতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে এবং চাঁদাবাজি রোধে ব্যবস্থা নেবে।
৫. রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত পরিবহন খাত
পরিবহন খাত থেকে রাজনৈতিক প্রভাব কমানো জরুরি। সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবমুক্ত একটি পরিবহন নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যা সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর হবে। এ নীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি নিরপেক্ষ সংস্থা কাজ করবে।
৬. পরিবহন শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষা
শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা গেলে তারা চাঁদাবাজিতে জড়িত না হয়ে সঠিকভাবে কাজ করতে উৎসাহিত হবে। শ্রমিকদের জন্য একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে তারা চাঁদা না দিয়েই কাজ করতে পারে।
৭. সর্বজনীন পরিবহন নীতি বাস্তবায়ন
একটি সমন্বিত ও সর্বজনীন পরিবহন নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে, যেখানে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। পরিবহন খাতের সব স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নীতি প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।
৮. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
জনগণকে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সচেতন করতে হবে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা যেতে পারে, যাতে তারা চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা হলে, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি কমানো সম্ভব হতে পারে এবং সাধারণ জনগণের ভোগান্তি কমবে।

তাজবীর সজীব শিক্ষক ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |